TECH GURU, TECH-SCIENCE NEWS

"I celebrate myself, and sing myself,
and what I assume you shall assume,
for every atom belonging to me as good belongs to you."

Monday, October 8, 2012

‘বিএনপি কি ক্ষমতায় এসেই গেছে?’



হবিগঞ্জের জনসভায় খালেদা জিয়া
হবিগঞ্জের জনসভায় খালেদা জিয়া
আমাদের দেশে যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁদের মাথা ঠিক থাকে না বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু বিরোধী দলে গিয়েও যদি কারও মাথা বেঠিক হয়ে যায়, তা মহা চিন্তার বিষয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের নেতাকে বিকল্প প্রধানমন্ত্রী ভাবা হয়। যদিও আমাদের দেশে কোনো বিরোধীদলীয় নেতাই দায়িত্বশীল আচরণ করেননি, এখনো করছেন না। কেননা, নির্বাচনের পরদিন থেকেই তাঁরা রাজনীতি শুরু করেন ‘মানি না মানব না’ স্লোগান দিয়ে। নির্বাচনে জয়ী হলে সবকিছু ঠিক আছে, নির্বাচন কমিশন ভালো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভালো, পুলিশ ভালো, বিজিবি ভালো, নিরাপত্তা বাহিনী—সব ভালো। আর নির্বাচনে পরাজিত হলে সবাই মন্দ হয়ে যায়, দেশদ্রোহী বনে যায়। ভোট কারচুপি, ভোট জালিয়াতি ও সাজানো নির্বাচনের এন্তার অভিযোগ নিয়ে আসেন মাননীয়ারা। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে স্থূল কারচুপি হয়েছে, দাবি করলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২০০১ সালের ফল যেমন আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না, তেমনি ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলও বিএনপি অদ্যাবধি মানতে পারেনি।
এই যে নির্বাচনে পরাজিত হলেই ফল মেনে না নেওয়ার অপসংস্কৃতি, এটা আমাদের গণতন্ত্রের প্রধান সমস্যা। আমাদের নেতা-নেত্রীরা কখনোই হারতে চান না। তাঁরা জনগণের ওপর ভরসা করেন না, ভরসা করেন দলীয় ক্যাডার-কর্মী-সমর্থক এবং কালোটাকা ও পেশিশক্তির ওপর। সেই পেশিশক্তি ও কালোটাকার জোরেও যখন তাঁরা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারেন না, তখন সব দোষ প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত করতে থাকেন। আর আমাদের সরকারগুলো এতটাই নির্বোধ যে বিরোধী দলের হাতে একটার পর একটা ইস্যু তুলে দেয়। গত বছর পর্যন্ত বিরোধী দলের প্রধান অস্ত্র ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও শেয়ারবাজারে ধস। এ বছর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু প্রকল্প জটিলতা, ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া, সাবেক রেলপথমন্ত্রীর এপিএসের গাড়ি থেকে ৭৪ লাখ টাকা উদ্ধার ইত্যাদি। দিন যতই যাবে, বিরোধী দলের হাতে নতুন নতুন ইস্যু যুক্ত হবে। 
বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বাকসংযমী মানুষ বলে একটা সুনাম ছিল। তিনি কম কথা বলেন। যা বলেন তা হিসাব-নিকাশ করে বলেন। পারতপক্ষে কাউকে আঘাত করে, অসম্মান করে কথা বলেন, সেই বদনাম ছিল না। কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক কথাবার্তা শুনে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনই মনে পড়ল। ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি তাই যাহা আসে কই মুখে’। গত মাসে দিনাজপুরে ১৮ দলীয় জনসভায় তিনি সরকারকে ‘মহাচোর’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। গত শনিবার হবিগঞ্জের জনসভায় বললেন, বিশ্বচোর। তাঁর ভাষায় ‘দেশ এখন বিশ্বচোর ও বিশ্ববেহায়ার কবলে পড়েছে।’ 
বিরোধী দলের নেতা আরও বলেছেন, ‘সরকার নাকে খত দিয়ে কানে ধরে ওঠবস করে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করতে ফের রাজি করিয়েছেন।’ দিনাজপুরের জনসভায় খালেদা জিয়া সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খরা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের একহাত নিয়েছেন। হবিগঞ্জের জনসভায় হুমকি দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক)। বলেছেন, ‘ঠিকমতো কাজ না করলে ভবিষ্যতে ধরা হবে।’ দুদক একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। ভবিষ্যতে এ প্রতিষ্ঠানকে ধরার কথা বলে তিনি কি তাদের খামোশ করতে চাইছেন? 
দুই জনসভায়ই খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছাড়া নির্বাচন হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে।’ দুই পক্ষের এ বিপরীত অবস্থানে জনগণের করণীয় কী? তারা কোথায় যাবে? এভাবে নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মল্লযুদ্ধ কত দিন চলবে?
বিরোধীদলীয় নেতা যখন বলেন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন হবে না, তার একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। কেননা, আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে বিএনপিই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু করেছিল। কিন্তু তিনি যখন দলীয় নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগার আত্মীয়স্বজন সম্পর্কেও সতর্ক থাকতে বলেন, তখন মনে হয় রাজনীতি রাজনীতির মাঠ ছেড়ে এখন শয়নকক্ষে ঢুকে পড়েছে। কে কার সঙ্গে আত্মীয়তা করবেন, আত্মীয়তা রাখবেন, সেসবও কি নেতা-নেত্রীরা ঠিক করে দেবেন? 
১৯৯৫-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চালাতে গিয়ে আওয়ামী লীগ জনতার মঞ্চ গড়েছিল, অসহযোগের ডাক দিয়েছিল। আমরা আশঙ্কা করি, বিএনপিও সেই পথ অনুসরণ করতে যাচ্ছে। খালেদা জিয়া বলেছেন, কোরবানির ঈদের পর তাঁরা কঠোর আন্দোলনে যাবেন, তাঁদের কর্মসূচিতে সরকার বাধা দিলে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। বাংলাদেশ অনেকবারই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এসেছে। ভবিষ্যতে কেউ ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা বললে গলা শুকিয়ে যায়। ভয়াবহ পরিস্থিতি কাকে বলে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রামুর বৌদ্ধপল্লির বাসিন্দারা টের পেয়েছেন। বিরোধী দলের নেতা কি সারা দেশের মানুষকেই তা টের পাওয়াতে চান? বিরোধী দলের নেতা যখন বলেন, সরকার ও সরকারি দলের লোকেরা এ কাণ্ড ঘটিয়েছেন, তখন তাঁর উচিত ছিল হবিগঞ্জে জনসভা না করে কক্সবাজারে যাওয়া। কেননা, সরকার ও সরকারি দলের মুখোশ উন্মোচন করাই বিরোধী দলের কর্তব্য। 
দুটি জনসভায় খালেদা জিয়ার এ চড়া মেজাজের ভাষণ শুনে মনে হচ্ছে, তিনি কোয়ার্টার ফাইনাল-সেমিফাইনাল শেষ করে এখন ফাইনাল রাউন্ডে এসে পড়েছেন। হয় জয় অথবা লয়। কিন্তু আমজনতার কী হবে? খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারকে ‘বিশ্বচোর’ এবং সরকারের অন্যতম শরিক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বলেছেন বিশ্ববেহায়া। ১৯৮৮ সালে শিল্পী কামরুল হাসানই এ নামেই তাঁর একটি কার্টুন এঁকেছিলেন। আমাদের বিস্মৃত হওয়ার কথা নয় এই বিশ্ববেহায়াকে নিয়েই খালেদা জিয়া ১৯৯৯ সালে চারদলীয় জোট করেছিলেন। ২০০৬-০৭ সালেও সেই ‘বিশ্ববেহায়া’কে জোটে টানতে নানা প্রলোভন দেওয়া হয়েছিল। এখনো বিএনপির অনেক নেতা তাঁকে মহাজোট ছেড়ে চলে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন। বিএনপি বাইরে যতই এরশাদকে গালাগাল করুক না কেন, কাজী জাফর ও রওশনকে দিয়ে মহাজোট ভাঙার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বড় দুর্বলতা হলো সাবেক স্বৈরাচারকে নিয়ে দুই পক্ষই টানাটানি করছে।
দ্বিতীয় কথা হলো, খালেদা জিয়া এসব কথা বলেছেন কাদের পাশে রেখে? তাঁর মঞ্চে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুহসীন হলে সাত হত্যা মামলার দণ্ডিত আসামি, ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের আতঙ্ক নামে পরিচিত ব্যক্তিও। বিরোধী দলের নেতা গণতন্ত্র ও সুশাসন কায়েমের কথা বলেন। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের নিয়ে কি তা সম্ভব? তিনি সরকারের সমালোচনা করতেই পারেন, কিন্তু শিষ্টতা ও শালীনতার সীমা অতিক্রম করা উচিত নয়। আমাদের দেশে অনেক নেতা-নেত্রীকে জিহ্বা সংবরণ না করার জন্য অনেক খেসারত দিতে হয়েছে, খালেদা জিয়াও কেন সেই দলে নাম লেখালেন? তিনি কি মনে করেন, আগামী নির্বাচনে বিজয়ের জন্য এসব অশিষ্ট ও কড়া ভাষাই উত্তম অস্ত্র? ১৯৯১, ২০০১ সালে কিন্তু তিনি এসব অশিষ্ট ভাষা ব্যবহার না করেই নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। রাজনীতিতে মত ও পথের ভিন্নতা থাকবে, নীতি ও আদর্শের লড়াই চলবে। কিন্তু সেসব ছাপিয়ে এখন ব্যক্তিগত কুৎসা ও বিদ্বেষ প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠছে। 
নেতা-নেত্রীদের মনে রাখা উচিত, সারা দেশে তাঁদের বিশাল কর্মিবাহিনী আছে, ভক্ত-অনুসারী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা আছেন, কিন্তু তাঁরা যদি তাঁদের ভাষা-ভঙ্গি অনুসরণ করেন, তা হলে দেশে রক্তারক্তি ঘটে যেতে পারে। এই যে নতুন প্রজন্মের কাছে, ভবিষ্যৎ নাগরিকদের কাছে তাঁরা কী উদাহরণ রেখে যাচ্ছেন? অনেকে বলবেন, ‘অপর নেত্রী’ এর চেয়ে বেশি অশিষ্ট ভাষায় কথা বলেন। মানুষ ভালোকেই অনুসরণ করে, মন্দকে নয়। 
কয়েক দিন আগে বিএনপির একজন প্রভাবশালী সাংসদের কাছে বিষয়টি তুললে তিনি বলেছিলেন, ‘দিনাজপুরে ম্যাডাম যে ভাষায় কথা বলেছেন, তাতে আমরাও বিস্মিত হয়েছি। এটি ছিল এত দিনকার বক্তৃতা-বিবৃতির বিপরীত।’ কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এ-ও বললেন, কখন বিরোধীদলীয় নেতা এসব কথা বলছেন, যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাঁকে প্রায় ৪০ বছরের পুরোনো বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। সংসদের ভেতরে-বাইরে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া সম্পর্কে অশালীন বক্তব্য দেওয়া হয়।
এসব হয়তো সত্য। তার চেয়েও বেশি সত্য একই আচরণ বিএনপি তথা চারদলীয় জোটের নেতা-নেত্রীরা, সাংসদেরাও করেছেন। কয়েক মাস আগে সংসদ যে স্পিকারের ভাষায় মাছের বাজার হয়ে গিয়েছিল, তার শুরুটা করেছিলেন বিএনপির পেছনের সারির সদস্যরাই। 
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমালোচনায় নেতা-নেত্রীরা কি আরেকটু মার্জিত হতে পারেন না? এ দেশেরই জননন্দিত নেতা-নেত্রী তাঁরা, পালা করে একজন প্রধানমন্ত্রী, আরেকজন বিরোধীদলীয় নেতা হন, কিন্তু সম্পর্ককে পাঞ্জাবি বনাম বাঙালিদের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সমীচীন নয়। 
রোম যখন পুড়ছিল, তখন নাকি নিরো বাঁশি বাজিয়েছিলেন। আজ রামু, উখিয়া ও পটিয়ায় যখন বৌদ্ধপল্লিগুলো জ্বলছে, যখন সেখানে আমাদের বৌদ্ধ ভাইবোনেরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, তখন নেতা-নেত্রীরা একে অপরকে ‘বিশ্বচোর’ ও ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ বলে বাগ্যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের কেউই আক্রান্ত বৌদ্ধদের পাশে দাঁড়ান না, অভয় দেন না।
দিনাজপুর ও হবিগঞ্জের জনসভায় খালেদা জিয়ার দেওয়া ভাষণ শুনে আমাদের এক সহকর্মী প্রশ্ন করলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এসেই গেল নাকি? না হলে তাঁদের নেতা দেড় বছর আগে থাকতেই এমন হুমকি-হুংকার ছাড়বেন কেন? আরেকজন বললেন, ক্ষমতায় এসে গেছে, তা সত্য নয়। বরং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নানা কসরত শুরু হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে? তিনি বললেন, কিছুদিন আগেও যে দলের নেতারা বলতেন—আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসেনি, দিল্লি-ওয়াশিংটন অক্ষশক্তি তাদের ক্ষমতায় বসিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই দিল্লি-ওয়াশিংটনের কৃপা পেতে তারা উদ্গ্রীব, এমনকি দলের নেত্রী বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটির বন্ধুত্ব কামনা করে বিদেশি পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছেন। 
কী বিচিত্র ক্ষমতার রাজনীতি। 


‘বিএনপি কি ক্ষমতায় এসেই গেছে?’ - প্রথম আলো

No comments:

Post a Comment