ষাটের দশক। স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা মানুষকে তটস্থ করে রেখেছে। কিন্তু হঠাৎ এক সপ্তাহের জন্য এ আবহ যেন পুরো বদলে গেল। সবার দৃষ্টি তখন পৃথিবীর বাইরে, পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের দিকে। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই পৃথিবীর ইতিহাসের স্মরণীয় এক দিন। ১৬ জুলাই অ্যাপোলো ১১ নভোযানে চেপেছিলেন নিল আর্মস্ট্রং ও তাঁর দুই সহকর্মী এডুইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স। চাঁদের উদ্দেশে পাড়ি দিয়ে ২০ জুলাইয়ের যে ক্ষণটিতে চাঁদের বুকে পা রাখলেন নিল আর্মষ্ট্রং, পৃথিবীর ৫০ কোটি মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় সে মুহূর্তের দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। চাঁদে পৌঁছানো পৃথিবীর প্রথম মানুষ আর্মস্ট্রংয়ের একটি ছোট পদক্ষেপই মানব জাতির অগ্রযাত্রাকে পৌঁছে দিয়েছিল চাঁদের উচ্চতায়।
অবশেষে ৮২ বছর বয়সে ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট মারা গেলেন চাঁদের মাটিতে পা রাখা পৃথিবীর সেই প্রথম মানুষটি। এ প্রসঙ্গে আর্মস্ট্রংয়ের পরিবারের বরাতে জানা গেছে, হূিপণ্ডের চারটি ধমনিতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে ৭ আগস্ট তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর সৃষ্ট জটিলতায় ২৫ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ওহিওতে ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন আর্মস্ট্রং। মাত্র ছয় বছর বয়সে বাবার সঙ্গে তিনি বিমানে চড়েছিলেন। এরপর থেকে ওড়ার প্রতি প্রবল এক অনুরাগ তাঁকে পেয়ে বসে। পঞ্চাশের দশকে কোরিয়া যুদ্ধের সময় তিনি নেভির যুদ্ধবিমান চালাতেন। ১৯৬২ সালে তিনি মার্কিন মহাকাশ কর্মসূচিতে যোগ দেন। অ্যাপোলো ১১ ছিল আর্মস্ট্রংয়ের শেষ মহাকাশ অভিযান। ১৯৭১ সালে তিনি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) ছেড়ে যান। পরে তিনি এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং (বিমান ও নভোযান প্রকৌশল) বিষয়ে পড়াতেন।
নিলের সহকর্মীরা জানিয়েছেন, একজন নভোচারী হিসেবে আর্মস্ট্রং সব সময়ই নিভৃতে থাকতে পছন্দ করতেন। তবে নিভৃত এ নভোচারীর ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন দারুন এক আশাবাদী মানুষ। তিনি মহাকাশ অভিযানের বিষয়ে সবসময়ই উৎসাহ দিয়েছেন এবং মহাকাশ মিশন সমর্থন করে গেছেন।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) প্রায় একযুগ আগে একবার বক্তৃতা করতে এসেছিলেন আর্মস্ট্রং। এক শিক্ষার্থী তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মি. আর্মস্ট্রং, আপনার কী মনে হয়, মানুষ কী কখনও মঙ্গলে যেতে পারবে?’ আর্মস্ট্রং তার উত্তরে বলেছিলেন.‘আমি ঠিক বলতে পারব না; তবে, আমি যখন তোমাদের বয়সী ছিলাম, সেসময় কখনও ভাবিনি যে আমরা একদিন চাঁদে যেতে পারবো’।
‘দারুণ এক আশাবাদী মানুষ ছিলেন আর্মস্ট্রং’। এ মন্তব্য করেছেন ম্যাসাচুসেটসের অধ্যাপক ল্যারি ইয়াং।
নিল আর্মস্ট্রংয়ের জীবনীগ্রন্থের নাম- ‘ফার্স্ট ম্যান’। বইটির লেখক জেমস আর হ্যানসেন। এ বইটি লেখার সময় লেখক আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে যে কথোপকথন চালিয়েছিলেন, তাতে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নিল সাধারণের মধ্যে খুব অসাধারণ একজন মানুষ। তাঁর মধ্যে সাধারণ মানুষের মতই সব দোষ-গুণ রয়েছে। কিন্তু তিনি অর্থ-বিত্তের পেছনে ছুটতে নারাজ। কারণ তাঁর জীবনদর্শন ছিল খুবই সাধারণ। এ বইটিতে চন্দ্রাভিযানের বর্ণনা ও আর্মস্ট্রংয়ের জীবনদর্শন তুলে এনেছেন লেখক।
হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গবেষক জোনাথান ম্যাকডাওয়েল আর্মস্ট্রং প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘চাঁদে পা রাখার পর নিলের বিখ্যাত উক্তি- ‘এটা একটা মানুষের জন্য ক্ষুদ্র পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য বিরাট এক পদক্ষেপ’ সেসময়কার তরুণ প্রজন্মের ওপর এ বিষয়টি বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। এসময় পুরো বিশ্বের মানুষ এক হয়ে গিয়েছিল। স্নায়ূযুদ্ধের বাস্তবতা ভুলে সবাই তখন চাঁদের দিকেই দৃষ্টি ফিরিয়েছিল।’
নিল আর্মস্ট্রংকে স্মরণ করেছেন তাঁর কাছের বন্ধু ও সহকর্মী এডুইন অলড্রিন। তিনি আর্মস্ট্রংয়ের পরেই চাঁদে পা রেখেছিলেন। অলড্রিন শোক প্রকাশ করে আর্মস্ট্রং স্মরণে এক টুইটে লিখেছেন, ‘আমি জানি হাজারো মানুষের সঙ্গে নিলের চলে যাওয়ার দুঃখ আমাকে স্পর্শ করছে, কিন্তু তিনি আমেরিকার সত্যিকারের নায়ক ও আমার দেখা সেরা পাইলট।’
আর্মস্ট্রংয়ের মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আর্মস্ট্রং কেবল তাঁর সময়েরই নন, বরং সর্বকালের মার্কিন নায়কদের মধ্যে মহানায়ক।’
সেদিনের অভিযানে আর্মস্ট্রংয়ের সহযাত্রী নভোচারী এডউইন অলড্রিন বিবিসির নিউজ আওয়ার অনুষ্ঠানে বলেন, আর্মস্ট্রং ছিলেন একজন হার না মানা বীর। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, চাঁদে অভিযানের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারলাম না।’
বিবিসি জানিয়েছে, শক্তিশালী দ্রুতগতির রকেটে চড়া মানুষের জন্য বেশ বিপদজনক একটি বিষয় ছিল। এটা সবাই করতে পারে না। নিল আর্মস্ট্রং ছিলেন বরফশীতল মস্তিস্কের একজন মানুষ। আর্মস্ট্রং যে নভোযানটি পরিচালনা করছিলেন সেটি চাঁদ থেকে পৃথিবীতে নেমে আসার সময় ধীরে ধীরে তার জ্বালানী শেষ হয়ে যাচ্ছিল। কন্ট্রোল রুমের সবাই সেসময় চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন ঠিক জায়গায় এটি নামতে পারবে কিনা তা নিয়ে। কিন্তু আর্মস্ট্রং ছিলেন ঠান্ডা মাথার। তিনি অপেক্ষা করলেন এবং অত্যন্ত স্থিরতার সাথে ঠিক জায়গাতেই নভোযানটিকে নামালেন।
নিল আর্মস্ট্রং ২৬ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী জেনেট এলিজাবেথ শ্যারনকে। বিয়ের পর, নবদম্পতি ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানেই আর্মস্ট্রং মার্কিন মহাকাশ মিশনের পাইলট হিসেবে যোগ দেন। বেল এক্স-১বি নামের রকেট প্লেনে তিনি শব্দের চেয়েও দ্রুতগতিতে চালানোর রেকর্ড গড়েন। এসময়কার কথা স্মরণ করে তাঁর সহকর্মী মিল্ট থম্পসন বলেছেন, ‘এক্স-১৫ চালকদের মধ্যে নিলই ছিল কারিগরি দক্ষতার সবচেয়ে পটু’। নিলের সেসময়কার আরেক সহকর্মী বিল ডানা জানান, ‘নিলের মন ছিল স্পঞ্জের মত, যা কোনো বিষয় সহজেই শুষে নিত পারত আর তার মস্তিষ্ক ক্যামেরার মতই ছবি তুলে রাখতে পারত।’ নিলই সম্ভবত সবচেয়ে উদ্ভাবনী ও বিপদজনক নভোযানগুলোর চালক হিসেবে কাজ করেছেন।
১৯৫৮ সালে আর্মস্ট্রংকে ‘এক্স-২০ ডায়না সোলার’ নামের মিলিটারি স্পেস প্লেন প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ করা হয় ও পরে চালক হিসেবে যুক্ত করা হয়। কিন্তু টগবগে তরুণ চালকের মন ততদিনে নাসার প্রকল্পের জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে জীবনীকার হ্যানসেনকে আর্মস্ট্রং বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, আমার নভোচারী হওয়ার আকাঙ্খা, চাঁদে যাওয়ার আকাঙ্খা থেকে হয়নি; বরং নতুন নভোযান চালানোর আগ্রহ থেকেই এসেছিল।’
হ্যানসেন উল্লেখ করেছেন, ‘নিল চাইলে তাঁর খ্যাতি ব্যবহার করে অনেক অর্থ আয় করতে পারতেন। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত জীবনে সেটা করেননি এবং চন্দ্র অভিযানের কৃতিত্ত্ব নিজে একার বলে দাবি করেননি বলেই মানুষ তাঁকে স্মরণ করে। ’
প্রসঙ্গত, আর্মস্ট্রং-জেনেটের সংসারে এসেছিল দুই ছেলে এরিক ও মার্ক এবং এক মেয়ে ক্যারেন। ১৯৬২ সালে মস্তিষ্কের টিউমারজনিত অসুস্থতায় ক্যারেনের মৃত্যু ঘটলে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন নিল। যদিও আর্মস্ট্রং-শ্যারনের সংসার বেশ অনেকদিনই টিকেছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ১৯৯৪ সালে এসে তাঁরা আলাদা হয়ে যান। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালের দিকে ক্যারোল নাইট নামের এক বিধবাকে বিয়ে করেন আর্মস্ট্রং।
আর্মস্ট্রংয়ের মৃত্যুর পর স্ত্রী জেনেট তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিল যা করেছেন তা শুধু বাইরের দৃষ্টিতে দেখলে হবে না, এর ভিতরটাও দেখা চাই। নিল অসাধারণ মজাদার এক জীবনযাপন করে গেছেন। কিন্তু মজার এ বিষয়টিকে তিনি হূদয়ের গভীরে অনুধাবন করেছিলেন।’
চাঁদে পা রাখা প্রথম মানুষ (ভিডিও) - প্রথম আলো
No comments:
Post a Comment