
নতুন ওষুধ সেবনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মারা যান নারায়ন সুরভিয়ার মা তিজুজা বাইভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে গোপনে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা নতুন ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সে পরীক্ষায় গিনিপিগের মতো ব্যবহূত হচ্ছে দেশটির নিম্ন বর্ণের হতদরিদ্র মানুষ। বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়ার দাবি করা হয়েছে।
২০০৯ সালের ঘটনা। নিতু সোদি তাঁর শাশুড়ি চন্দ্রকলা বাইকে নিয়ে ইন্দোরের মহারাজা যশবন্তরাও হাসপাতালে যান। শাশুড়ির বুকে ব্যথা হওয়ার কারণে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি।
নিতু বলেন, ‘আমরা নিম্নবর্ণের মানুষ। দলিত সম্প্রদায়ের। আমাদের অস্পৃশ্য মনে করা হয়। হাসপাতালে চিকিত্সকের দেখা পেতে তাই আমাদের দীর্ঘ সময় লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সেদিন আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, চিকিত্সক আমাদের অনেক দামি ওষুধ দিলেন। হাসপাতালে গেলে মাত্র পাঁচ রুপিতে একটি রসিদ দেওয়া হয়েছিল। চিকিত্সকেরা বলেন, তাঁরা আমাদের এক লাখ ২৫ হাজার রুপি দামের ওষুধ দেবেন।’
নিতু বলেন, ‘রোগের চিকিত্সার ব্যয় বহন করার মত সামর্থ্য নেই আমাদের। কিন্তু চিকিত্সকেরা পাঁচ রুপির রসিদ নিয়ে বলেছিল, বেশি দামের ওষুধের বাকি অর্থ সরকারি বিশেষ তহবিল থেকে জোগানো হবে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিতু বুঝতেই পারেননি যে তাঁর শাশুড়ির ওপর ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বায়োজেনের ‘টোনাপোফিলিন’ ওষুধের পরীক্ষা চালাচ্ছেন চিকিত্সকেরা। তিনি জানান, এ ওষুধ দেওয়ার আগে চিকিত্সকরা তাঁদের আগে থেকে কোনো কিছু পড়তে বা কোনো কাগজে সই করতেও বলেননি।
নিতু জানান, এ ওষুধ সেবনের পর তাঁর শাশুড়ির হূদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়। তিনি কিছুদিন এ ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেন। এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মারা যান তিনি।
বহুজাতিক ওষুধ নির্মাতা অনেক প্রতিষ্ঠান ভারতের নিম্নবর্ণের গরিবদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করছে। চন্দ্রকলা বাইয়ের বেলায়ই যে কেবল এমনটি ঘটেছে, তা নয়। একই ঘটনা ঘটেছে নারায়ণ সুরভাইয়ার ক্ষেত্রে। তাঁর মায়ের চিকিত্সার সময় নতুন ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কোনোরূপ অনুমতি নেননি চিকিত্সকেরা। পায়ের সমস্যার জন্য চিকিত্সকের শরণাপন্ন হওয়ার পর তাঁকে দামি ওষুধ দেওয়া হচ্ছে বলে জানানো হয়। ওষুধের খরচ দাতব্য খাত থেকে আসবে বলে নিশ্চিত করা হয়। ওষুধ সেবনের পর সুরভাইয়ার মায়ের স্বাস্থ্যহানি ঘটে এবং তিনি পঙ্গু হয়ে যান।
সুরভাইয়া বলেন, নতুন ওষুধ সেবনের পর মায়ের শরীর খারাপ হতে শুরু করলে আমি চিকিত্সককে ঘটনাটা জানিয়েছিলাম। চিকিত্সকদের পরামর্শ ছিল ওষুধ চালিয়ে যাওয়ার। চিকিত্সক সুরভাইয়াকে জানিয়েছিলেন, ওষুধ সেবনে সাময়িকভাবে শরীর অচল হয়ে যেতে পারে, পরে ঠিক হয়ে যাবে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সুরভাইয়ার মা মারা যান।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বহুজাতিক ওষুধ নির্মাতা অনেক প্রতিষ্ঠান ভারতের নিম্নবর্ণের গরিব মানুষকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করছে। গত সাত বছরে তিন হাজার ৩০০ রোগীর মধ্যে ৭৩টি ওষুধের পরীক্ষা চালানো হয়েছে ইন্দোরের মহারাজা যশবন্তরাও হাসপাতালে। এর মধ্যে পরীক্ষায় ব্যবহুত মানুষের মধ্যে অধিকাংশই শিশু। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা পরীক্ষামূলকভাবে ওষুধ সেবন করতে গিয়ে অনেকেই মারা গেছে। কিন্তু মারা যাওয়ার পর তাঁদের পরিবারকে কোনোরকম সাহায্য করা হয়নি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের মধ্য প্রদেশের ভোপালের কারবাইড প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের পর গ্যাস দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রায় ২৫ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। এ দুর্ঘটনাকবলিত মানুষের ভরসাস্থল ছিল ভোপাল মেমোরিয়াল হাসপাতাল। এ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল ড্রাগ ট্রায়াল সম্পর্কে রোগীরা খুব কমই জানতে পারেন। সেখানে চিকিত্সা নিতে যাওয়া অনেকেই বিভিন্ন জটিলতার শিকার হয়েছেন এবং মারাও গেছেন। এসব ওষুধ হাসপাতালের বাইরে পাওয়া যায় না।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে নতুন ওষুধ সেবনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত সাত বছরে দেশটিতে দুই হাজারেরও বেশি পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বায়োজেন থেকে শুরু করে গ্ল্যাক্সো স্মিথের নাম। ২০০৮ সালে ওষুধ পরীক্ষার কারণে ২৮৮ জন মারা যান। ২০১১ সালে মৃতের সংখ্যা ৪৩৮ জনে পৌঁছায়।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সময় ওষুধ সেবনেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে—এমন কোনো তথ্য প্রমাণ নেই। কারণ, এসব গরিব রোগীদের মারা যাওয়ার পর কারও ময়নাতদন্ত হয়নি। হাসপাতালের চিকিত্সকেরা নানাভাবে দরিদ্র রোগীদের ওষুধ সেবনের প্রলোভন দেখায়। তাদের সাধ্যের বাইরে থাকা ওষুধ সেবনের জন্য পরামর্শ দেয় এবং বিনামূল্যে তা জোগাড় করার ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা জানায়।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সময় রোগীর সঙ্গে বিধিসম্মতভাবে চুক্তি সই করতে হয়। এ বিপজ্জনক পরীক্ষার রোগীকে ব্যবহার করার ব্যাপারে সম্মতি নেওয়া তো দূরের কথা পুরো বিষয়টি অতি গোপন রাখা হয়। বিষয়টি গোপনে সারতে অবৈধভাবে অর্থ ব্যয় করে বহুজাতিক ওষুধ ব্যবসায়ীরা।
আন্তর্জাতিক স্তরেও ভারতের মতো দেশে যেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও গবেষণা পদ্ধতির উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট কম, যেখানে মানুষকে নির্বিচারে সহজেই পরীক্ষার মাধ্যম করে তোলা যায়, সেখানে ট্রায়াল কতটা সঠিক হচ্ছে সম্প্রতি সেই প্রশ্ন জোরালো হয়ে উঠছে। পরীক্ষা পদ্ধতির স্বচ্ছতা, গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও তৈরি হচ্ছে নানা বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছে, যে হারে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাড়ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই ব্যাপারে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা বাড়ছে না। নিরুপায় হয়ে যারা নিজেদের শরীরে এই পরীক্ষা চালাতে দিচ্ছে তারা জানেই না ব্যাপারটা কী? অধিকাংশই নিরক্ষর, লিখিত সম্মতিদানের প্রশ্ন ওঠে না।
হতদরিদ্র মানুষদের মধ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষার এ বিষয়টি চোখে পড়েছিল চিকিত্সক আরনান্দ রাইয়ের। এ বিষয়ে মুখ খোলার জন্য হাসপাতাল থেকে তাঁর চাকরি চলে যায়। বর্তমানে তিনি হাসপাতালে দরিদ্র মানুষের ওপর ওষুধ পরীক্ষার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন।
গবেষক আরনান্দের ভাষ্য, পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য সব শ্রেণীর মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার নিয়ম থাকলেও কেবল দরিদ্র, অশিক্ষিত রোগীদের বেছে নেওয়া হয় যারা মোটেও ক্লিনিক্যাল ড্রাগ ট্রায়াল বিষয়টি জানেন না।
মহারাজা যশবন্তরাও হাসপাতালের এথিকস কমিটির প্রধান ড. কেডি ভার্গভ স্বীকার করেছেন যে, হাসপাতালটিতে ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার বিষয়টি বেড়ে গেছে। হঠাত্ করেই এতে অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ সংক্রান্ত বিষয় জড়িয়ে গেছে এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
ইন্দোরের আইনজীবী সাটনাম সিং বেইনসের মতে, ভারতে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতারণা করা হচ্ছে, অবৈধ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তথ্য গোপন করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে সঠিক তদন্ত করা হচ্ছে না। অনেক ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তথ্য আন্তর্জাতিকভাবে নির্ভরযোগ্যতার বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
গরিব বলেই গিনিপিগ? - প্রথম আলো