
রবীন্দ্রনাথ তাঁর নৌকাডুবিতে এক চরিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন, পুরুষ মানুষ হীরার আঙটি, কোনো ব্যাকা-ত্যাড়া নাই। কোনো কিছুতেই যেন পুরুষের দাম কমেনা ।
কিন্তু বিজ্ঞানীদের চোষে পুরুষ নয়, হীরার আঙটি নারীরাই। কারণ, নারীরাই সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু।
হীরার আঙটির প্রচলন যুগ যুগ ধরেই রয়েছে।বিয়ে জীবনের গুরুত্বপু্র্ণ এবং স্মরণীয় মুহুর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম৷ তাই বিয়েতে চাই সবার পছন্দের সেরা জিনিসগুলো৷ নিজের ও জীবনসঙ্গীর জন্যও চাই পছন্দনীয় কেনাকাটা৷ বিয়ের অন্যতম কাজ হচ্ছে বাগদান৷ আর বর্তমান সময়ে বাগদানে স্বর্ণেরও চেয়ে হীরার আংটির চাহিদা অনেক বেশী৷ কারণ এ সময়টাকে স্মৃতিময় করে রাখে বাগদান আংটি৷ তা যত দামই হোক না কেন, এখানে দামের চেয়েও বেশি গুরুত্বের সাথে দেখা হয় আংটিটা তার অনামিকায় কতটা মানিয়েছে৷
বাগদান আংটি সম্পর্কের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়৷ একটি স্থায়ী সম্পর্কের জন্য এটি একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য নির্দেশ করে৷ বাগদানের আংটি পরার ইউরোপীয় এ আচার বর্তমানে সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রচলিত৷ কিছু কিছু সংস্কৃতির বৈবাহিক আচারে আংটি প্রদান একটি নির্দিষ্ট ধারার উপহার সামগ্রী হিসেবে গণ্য৷ এ ধারাটি শুরু হয় বাগদানের আংটি প্রদানের মাধ্যমে৷ বাগদানের আংটি প্রদানের রেওয়াজ প্রাচীন রোমেও প্রচলিত ছিল৷ ধারণা করা হয়, রীতির প্রচলনকাল এর থেকেও পুরোনো৷ বর্তমানে অন্যান্য বেশকিছু আচার তৈরি হয়েছে, যা মূলত গহনা ব্যবসায়ীদের সৃষ্টি৷ এর মধ্যে আছে বাগদানের পূর্বেই উপহার হিসেবে বিভিন্ন রকম আংটির ব্যবহার৷ এর মধ্যে আছে সত্যিকারের সম্পর্ক শুরু হওয়া উপলক্ষে আংটির ব্যবহার, চিরকাল সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাকে স্মরণ করে আংটি আদান প্রদান ইত্যাদি৷ এমন কী কিছু ক্ষেত্রে প্রথম সন্তান জন্মের পর তা স্মরণ করেও আংটি প্রদানের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে৷ এছাড়াও আছে সম্পর্কের অতীত, বর্তমান, ও ভবিষ্যতের স্মরণে প্রদেয় আংটি, যা সাধারণত গোল করে কাটা হীরা ব্যবহার করে তৈরি করা হয়৷
১৭৯৬ সালে জোসেফিনকে দেয়া ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বাগদান আংটিটি সমপ্রতি নিলামে ৯ লাখ ৪৯ হাজার ডলারে বিক্রি হয়েছে৷ জোসেফিনের ২৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্যারিসে আংটিটি নিলামে তোলে অসেনাট৷
২০১০ সালে প্রিন্স উইলিয়াম তার স্ত্রী কেট মিডেলটনকে বাগদানের সময় প্রায় আট ক্যারেট হীরার আংটি দিয়েছিলেন৷ খোলাবাজারে এ ধরনের আংটির দাম হতে পারে আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত৷ উইলিয়াম এ আংটিটি তার মা প্রিন্সেস ডায়ানার কাছ থেকে পেয়েছেন বলে এর দামের ক্ষেত্রে অনুমানই একমাত্র ভরসা৷
তবে ব্রিটিশ আধুনিক নারীরা প্রত্যাশা করেন সম্ভাব্য জীবনসঙ্গী যেন নিজের সর্বোচ্চ সামর্থ দিয়ে বাগদান আংটি কেনেন৷ এটা হতে পারে তার এক মাসের আয়ের পুরো অর্থ৷ তবে মজার ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ পুরুষরা চান বাগদান আংটি কেনায় আরো বেশি অর্থ ব্যয় করতে৷
হীরার আঙটি নিয়ে একটি কুসংস্কার রয়েছে আর তা হচ্ছে বিয়েতে হীরার আঙটি অশুভ। কারন সবার হীরা সহ্র হয়না। একটিমাত্র বিয়ের জন্যে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে একাধিক অনুষ্ঠান আয়োজনের পাশাপাশি পোশাক ও অলঙ্কার কেনাকাটা করতে গিয়ে হয় টাকার শ্রাদ্ধ। ঋণ করে হলেও বিয়ের এই ফুটানি করতে গিয়ে অনেক পরিবার দুর্দশায় নিপতিত হয়। বিয়েতে দেয়া হীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পারিবারিক অশান্তি বয়ে আনে। কারণ হিসেবে ধরা হয়, হীরা বেশিরভাগ মানুষের জন্যেই অশুভ।
হীরা কিংবা সোনার সেরকম কোন ব্যবহারিক উপযোগিতা কেউ কখনোই খুঁজে পায়নি। অথচ তারপরেও হীরা বা সোনার গয়নার জন্য সুযোগ পেলেই হামলে পড়ে মেয়েরা। আর ছেলেরাও ভালবাসার প্রমাণ হিসেবে ১০৮ টি নীলপদ্মের মতো হাজির করতে চায় নারীর কাছে অমূল্য হীরা। কিন্তু কেন?
ডারউইনের সেক্সুয়াল সিলেকশন তথা যৌনতার নির্বাচনের মধ্যেই এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে। যৌনতার নির্বাচনের বহুল প্রচলিত ময়ূরের পেখমের উদাহরণটি এখানে বলা চলে। আমরা জানি, ময়ূরের দীর্ঘ পেখম টিকে আছে মূলতঃ নারী ময়ূর বা ময়ূরীর পছন্দ তথা যৌনতার নির্বাচনকে প্রাধান্য দিয়ে। কি ভাবে? ১৯৭৫ সালে ইসরাইলী জীববিজ্ঞানী আমোতজ জাহাভি জানান যে, ময়ূরীর এই দীর্ঘ পেখম ময়ূরের কাছে প্রতিভাত হয় এক ধরণের ‘ফিটনেস ইণ্ডিকেটর’ বা সুস্বাস্থ্যের মাপকাঠি হিসেবে। জাহাবির মতে, সততার সাথে সুস্বাস্থ্যের বিজ্ঞাপন দিতে গেলে এমন একটা কিছুর মাধ্যমে সেটা প্রকাশ করতে হবে যাতে খরচের প্রাচুর্যটা এমনকি সাদা চোখেও ধরা পড়ে। সোজা ভাষায় সেই বিজ্ঞপিত অঙ্গটিকে নিঃসন্দেহে হতে হবে ‘কস্টলি অর্নামেন্ট’, ব্যয়বহুল, অপব্যায়ী কিংবা জবরজং ধরণের জটিল কিছু।ময়ূরের পেখম কেবল ময়ূরীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সস্তা প্রচারণা নয়। ময়ূরের পেখম দীর্ঘ, ভারী আর ভয়ানক বিপদসঙ্কুল। দীর্ঘ পেখম এত অনায়াসে তৈরি করা যায় না, আর এমনকি এই বেয়াক্কেলে পেখমের কারণে তার শিকারীদের চোখে পড়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায় অনেক। বেচারা ময়ূরকে কেবল নিজের দেহটিকেই বয়ে বেড়াতে হয় না, টেনে হিচড়ে নিয়ে বেড়াতে হয় তার পশ্চাৎদেশের সাথে জুড়ে থাকা এই অবিশ্বাস্য বড় ধরণের বাড়তি একটা পেখমের ঝাঁপি । একে বলা হয় হ্যান্ডিক্যাপ প্রিন্সিপাল। এজন্য ময়ূরকে হতে হয় স্বাস্থ্যবান এবং নিরোগ। কখনো সখনো কোন স্বাস্থ্যহীন ময়ূরের দীর্ঘ পেখম গজাতে পারে বটে, কিন্তু সেটা বয়ে নিয়ে বেড়িয়ে খাবার খোঁজা, কিংবা শিকারীরা তাড়া করলে দ্রুত দৌঁড়িয়ে পালিয়ে যাওয়া সেই স্বাস্থ্যহীন ময়ূরের পক্ষে দুঃসাধ্যই হবে। কেবল মাত্র প্রচণ্ড শক্তিশালী কিংবা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ময়ূরের পক্ষেই এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে এ ধরণের পেখমের বিলাসিতা ধারণ করা সম্ভব হয় । শিক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তি, জ্ঞান, সাহস, দৈহিক শক্তি, সঙ্গিত প্রতিভা, বাকচাতুর্য, সুদর্শন চেহারা, কৃষ্টি, নৃত্যপটুতা, প্রগতিশিলতা, অধিকার সচেতনতা, উদ্ভাবনী শক্তি, দৈহিক সৌন্দর্য, সততা, নৈতিকতা, দয়াপরবশতা, রসিকতা, হাস্যরসপ্রিয়তাসহ অনেক কিছু নিয়ামক হলেও কোনটিই বিয়ের সময় হীরার আংটির মতো গুরুত্বপূর্ণ ‘ভালবাসার উপঢৌকন’ হিসেবে উঠে আসে না। জাহাভির হ্যাণ্ডিক্যাপ প্রিন্সিপাল অনুযায়ী, বিয়ের প্রস্তাবের উপহার এমন হতে হবে যার কোন ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই , কিন্তু বিপরীত লিঙ্গের চোখে তা হতে হবে অমূল্য। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে ‘কোর্টশিপ গিফট’ বা ‘নাপশাল গিফট’।
বাড়ি-গাড়ি, আ্ইফোন বা যাকিছুরই ব্যবহারিক কিছু না কিছু উপযোগিতা আছে সেগুলো কখনোই ‘কোর্টশিপ গিফট’ হয়ে উঠার যোগ্য নয়। কোর্টশিপ গিফট গতে পারে কেবল হীরা কিংবা স্বর্ণালঙ্কারের মত বস্তু যা নারীর মানসপটে সেটি অমূল্য এক ‘ফিটনেস মার্কার’।
পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পদার্থ হীরা একইসঙ্গে সবচেয়ে বেশি চাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। সে হিসেবে সম্ভবত কোনো প্রিয়জন নন, অলংকার কিংবা আভরণ হিসেবে নারীর সবচে কষ্টসহিষ্ণু সঙ্গী এই হীরাই।
পৃথিবীর কেন্দ্রে মোট চাপের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩ মিলিয়ন অ্যাটমোস্ফিয়ার। সেখানে ১ মিলিয়ন অ্যাটমোস্ফিয়ার চাপেরও বেশি সহ্য করতে পারে হীরা। আর মানুষের শরীরের ক্ষেত্রে ক্রমাগ্রত চাপ সহ্য করার ক্ষমতা ২৭ অ্যাটমোস্ফিয়ারের। এক্ষেত্রে অবশ্য মানসিক চাপ সহ্য করার বিষয়টি বাদই থেকে গেছে!
লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি (এলএলএনএল) এর একদল গবেষক ১০০ ক্যারাটের একটি ছোট্ট হীরার ওপর লেজার রশ্মি ব্যবহার করে এই পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। এতে দেখা যায় ২ ন্যানোসেকেন্ডেরও কম সময়ে হীরা ২০০ জুলেরও বেশি শক্তি তৈরি করতে পারে। লেজার রশ্মি দিয়ে পরীক্ষার সময় বিজ্ঞানীরা দেখেন হীরা একটি শকওয়েভ তৈরি করে। সেই শকওয়েভ থেকেই হীরা ১ মিলিয়ন থেকে ১০ মিলিয়ন অ্যাটমোস্ফিয়ার পর্যন্ত চাপ সহ্য করতে পারে বলেই বিজ্ঞানীরা হিসেব বের করেছেন।
পৃথিবীর ৮৭ থেকে ১২০ মাইল অভ্যন্তরে অত্যন্ত উচ্চ চাপে প্রাকৃতিক হীরা তৈরি হয়। আর এই হীরা গঠনে সময় লাগে ১০০ কোটি থেকে সাড়ে ৩শ’ কোটি বছর পর্যন্ত। যেখানে পৃথিবীর বয়স ধরা হয় সাড়ে ৪শ’ কোটি বছর।
(তথ্যসূত্র: ব্লগ, অনলাইন সংবাদমাধ্যম)